নিজস্ব প্রতিবেদক : চারুকলায় শিল্পী রফিকুন্নবীকে মঞ্চে উঠতে দেয়া হয়নি! কারণ জানতে চাইলে, “তারা কেন এমন করল জানি না”, বলেন রফিকুন নবী।
গত সোমবার অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ২০২৪–এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই ঘটনা ঘটে।
উক্ত অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য শিল্পী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী। দুপুর ১২টার দিকে তিনি সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের তৈরি শিল্পকর্ম দেখেন এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। তার সাথে ছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী জয়নুল আবেদিনের ছেলে মইনুল আবেদিন।
এমতাবস্থায় অনুষ্ঠান শুরুর আগে হঠাৎ করে আয়োজকরা জানান, রফিকুন নবী মঞ্চে উঠলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না।
চারুকলার জয়নুল উৎসব ও বার্ষিক প্রদর্শনী শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন কার্টুন শিল্পে রনবী নামে খ্যাত চিত্রশিল্পী ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন্নবী, তিনি সেখানে উপস্থিতও ছিলেন কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে মঞ্চে না ওঠার অনুরোধ জানানো হয়, যদিও তিনি অনুষদের অধ্যাপক পদে এখনো আসীন। বিষয়টি কেউই শিক্ষিত লোকের আচরণ বলে মেনে নেননি এবং এটা একটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ঘটনা বলেও অনেকে মত প্রকাশ করেন।
এছাড়াও বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে চিত্রশিল্পী কামাল পাশা চৌধুরী ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। ওই পোস্টে তিনি বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, অনুষদের পেইন্টিং বিভাগের বার্ষিকীর প্রদর্শনীর ওই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন দেশের প্রবীনতম প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী, যিনি কার্টুন শিল্পে রনবী নামে বিখ্যাত টোকাই চরিত্রের স্রষ্টা, এমিরেটাস অধ্যাপক রফিকুন্নবী। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বেই চারুকলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে বলা হয় মঞ্চে না যাওয়ার জন্য। যদিও এখনও তিনি চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক পদে আসীন।
এ ঘটনা নিশ্চিত করে অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘আমরা অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা করছিলাম। স্যার আমারও শিক্ষক। তাই তার সম্মান বাঁচাতে বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে স্যারকে অনুষ্ঠানে না আসার অনুরোধ জানাই।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, অনুষ্ঠানে নিয়মিত পুরস্কার তালিকার বাইরেও শিল্পী রফিকুন্নবী এবার ব্যক্তিগতভাবে একজন সেরা ছাত্রকে ২০ হাজার টাকা মূল্যমানের একটি পুরস্কার দেবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর আগেই তাকে মঞ্চে উঠতে বাধা দেয়া হয়। এ অনুষ্ঠানে আরো অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ। তবে শিল্পী রফিকুন্নবী মঞ্চে থাকলে উপ-উপাচার্য অনুষ্ঠানে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদকে একাধিকার ফোন করা হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন, ‘উপ-উপাচার্য আপত্তি জানিয়েছেন কিনা আমি বলতে পারব না। তবে শিক্ষার্থীদের থেকে আপত্তি ছিল। অনুষ্ঠানস্থলে চারুকলার বাইরের কিছু ছাত্রকে হট্টগোল করতে দেখা যায়।’
🔴 অধ্যাপক মামুন আহমেদঃ
গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ইং, বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) পদে নিযুক্ত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচিত তাহের উদ্দিন ঠাকুরের ছেলে একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপ-উপাচার্য মামুন আহমেদ বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এবং জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার সভাপতি।
🔴 রকিকুন নবীঃ
উপনাম রনবী, বাংলাদেশের খ্যাতনামা একজন চিত্রকর, কার্টুনিস্ট। “টোকাই” নামক কার্টুন চরিত্রটি তার অনবদ্য সৃষ্টি। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে টোকাই কার্টুন স্ট্রিপ হিসেবে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। শিল্পকলায় তার অনন্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন।
রফিকুন নবী ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রশীদুন নবী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা আনোয়ারা বেগম ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। তার স্ত্রীর নাম নাজমা বেগম।
পড়াশোনা শেষ করে রফিকুন নবী সে সময়ে ঢাকার প্রথম সারির পত্রিকাগুলিতে নিয়মিত কাজ শুরু করেন। নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকায় কবি আবদুল গনি হাজারির কলাম কাল পেঁচার ডায়েরীতে৷ ১৯৬৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করেন তিনি৷ আর্ট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নিয়ে তার শিক্ষকতা জীবনের শুরু হয়৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, কাপড় ও খাদ্য সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে গ্রীক সরকারের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বৃত্তি নিয়ে তিনি ভর্তি হলেন গ্রীসের এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্ট-এ৷ পড়াশোনা করলেন প্রিন্ট মেকিং-এর ওপর৷ ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি৷ শিক্ষক থেকে ধীরে ধীরে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের পদে অধিষ্ঠিত হন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ফাইন আর্টস-এর ড্রইঙ ও পেইন্টিং বিভাগে প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই ইন্সটিটিউটের পরিচালক। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করছেন।
১৯৭৮ সালের ১৭মে টোকাই শিরোনামে প্রথম স্ট্রিপ কার্টুনটি ছাপা হয় বিচিত্রার প্রারম্ভিক সংখ্যায়। প্রথম কার্টুনে টোকাই একজন বড় কর্মকর্তা৷ বসে আছে তার বানানো অফিসে৷ রাস্তার ইট দিয়ে তৈরি একটি টেবিলে৷ প্রথম কার্টুনেই বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া টোকাই নিয়মিত বিচিত্রায় ছাপা হয়৷ ২০০০ সাল থেকে সাপ্তাহিক ২০০০-এ শুরু হয় আঁকা হলেও ২০০৪ সালের দিকে নিয়মিত টোকাই আঁকা বন্ধ করেন তিনি। টোকাইয়ের মাথায় টাক, কখনও গুটিকয়েক চুল, খাটো চেক লুঙ্গি মোটা পেটে বাঁধা৷ কখনো কাঁধে বস্তা৷ ‘৭৮-‘৭৯-এ ভোটের সময় বিলি করা জামা পরেছিল টোকাই, সেই জামাটি ছিল ওর থেকে অনেক বড় আকারের৷ থাকে রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে, ফুটপাতে, ফেলে রাখা কংক্রিটের পাইপের ভেতর, পার্কের বেঞ্চিতে, ভাঙা দেয়ালের পাশে, কাঠের গুঁড়িতে, ঠেলা গাড়ির ওপরে, ইটের ওপর মাথা পেতে৷ তার পাশে থাকে কুকুর, কাক৷ কথা বলে কাক, গরু, ছাগল, মশার সাথে৷ কথা বলে মানুষের সাথেও৷ তার কথা বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণতায় ভরা, আবার রসে সিক্ত৷ পেন অ্যান্ড ইঙ্কের পরে টোকাই হাজির হল জলরঙের উচ্ছলতায়৷ সেখানে সে কখনও মনের আনন্দে মার্বেল গুটি দিয়ে খেলে, নৌকা চালায়, বাঁশি বাজায়, বেহালা বাজায়, কখনও রাস্তার বুকে উবু হয়ে লিখতে শুরু করে, কখনও আনন্দে দেয় ছুট৷ কখনও একা বসে থাকে, আবার কখনও পাঁচিলের উপরে উঠে পাশের দেয়ালের অপর দিকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে, রাজকীয় বাড়ির দরজায় হাজির হয় কাঁধে বস্তা নিয়ে৷ রনবীর টোকাই এভাবে সমাজ-সংসারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলে প্রতিনিয়ত৷ মূলত টোকাই চরিত্রটি বাস্তবের এমন কিছু পথশিশুর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা, মানুষের ফেলে দেয়া আবর্জনা, কুড়িয়ে নিয়ে যায বা টুকিয়ে নিয়ে যায়। বাস্তবের সেসব পথশিশুকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে টোকাই’র বাসস্থান হলো আস্তাকুঁড়ে বা ডাস্টবিনের কাছাকাছি, ফুটপাত, কিংবা পতিত বড় পাইপ, যা তার বাস্তুহীনতাকে প্রতীকায়িত করে। তার পোশাক বলতে একমাত্র লুঙ্গি, যা তার দারিদ্রকে প্রতীকায়িত করে। অন্য অর্থে টোকাই প্রতীকতাবর্জিত একটি চরিত্র, যে প্রায় বাস্তবই তুলে ধরে। এঅর্থে টোকাই চরিত্রে প্রতীকতা খোঁজার অবকাশ নেই।