মঞ্জুর মোর্শেদ : ২০১১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) প্রভাষক হিসাবে দর্শন বিভাগে যোগদানকারী সহযোগী অধ্যাপিকা নাসরিন সুলতানা তাঁর ফেসবুককে একটি পোস্ট লিখে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পতিত হন। আলোচ্য পোস্টটিতে তাঁর লেখার বিষয়বস্তু ছিলো বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের বহুল আলোচিত মেধাবী যুবক মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ।
গত শনিবার (২৩ নভেম্বর) রাতে জাবির এই শিক্ষিকা তাঁর নিজ ফেসবুক আইডিতে লেখেন, ‘কিছুদিন আগে একজন মেসেজ দিয়ে বললো, সবাই আবু সাঈদের কবরে যায়, কিন্তু মুগ্ধর কবরে যায় না কেন? আমি বললাম, কারণ, আবু সাঈদ জামায়াতের লোক ছিল, তাদের লোক ছিল। এরপর সে আমার উত্তরে হা হা রিয়েকশন দিলো। হা হা রিয়েকশনের অর্থ তখন বুঝিনি। কাল একজন বললো, মুগ্ধর লাশ, কবরের নাকি হদিস পাওয়া যায়নি। মুগ্ধর পরিবার নাকি কোনও মামলাও করেনি। মুগ্ধর ভাই নাকি বিদেশে ঘুরেফিরে ছবি আপলোড করে বেড়াচ্ছে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘আজ শুনলাম মুগ্ধ নাকি ফ্রান্সে। নিজের কানকে তো বিশ্বাস করতে পারছি না।’
এই পোস্টটি তাঁর আইডি থেকে প্রকাশিত হবার পর পরই শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রচন্ড রকম চাপের মুখে পরেন শিক্ষিকা নাসরিন সুলতানা। এ বিষয়টিকে শিক্ষকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘন বলে গণ্য করেন শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষিকার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তেরও দাবি জানিয়েছেন অনেকেই।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সিফাত বলেন, ‘অবিলম্বে এই আওয়ামী দোসরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’
এমতাবস্থায় বাধ্য হয়ে তিনি তার লেখা ওই পোস্টটি ডিলিট করে আরেকটি পোস্ট লেখেন।
তখন তিনি লেখেন, ‘আমার আগের স্ট্যাটাস অনেকের মনে কনফিউশন তৈরি করেছে বলে ডিলিট করা হলো। আমি শুধু লোকজন আমাকে কী বলেছে, সেটা বলেছি। আমি নিজের কোনও মতামত দিইনি। কারও মনে আঘাত দিয়ে থাকলে আমি দুঃখিত।’
এদিকে এ বিষয়টি নিয়ে আরোও জানার উদ্দেশ্যে এক সাংবাদিক তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
প্রসঙ্গত, মিডিয়ার বরাত দিয়েই জানা যায় যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। গণমাধ্যমে প্রকাশ, আন্দোলন চলাকালীন ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে পানি বিতরণ করছিলেন মুগ্ধ, এমন সময় হঠাৎ করে সংঘর্ষ বাঁধে, তখন পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে এবং মুগ্ধ পুলিশের ছোঁড়া গুলিবিদ্ধ হন, তাৎক্ষণিক তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নির্বিচারে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যার শিকার হয়েই অগণিত ছাত্রজনতার মৃত্যু ঘটে, -এমন খবরই দেশের সকল গণমাধ্যম থেকে প্রকাশ করা হলে পরে “পুলিশ” কথাটিই একটা ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আন্দোলন মারাত্মক রুপ ধারণ করে। এরপর প্রতিশোধ নিতে অগণিত পুলিশ সদস্যদেরও হত্যা করা হয় কিন্তু পরবর্তীতে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন তখন) গুলিতে নিহত ব্যক্তিদের অবস্থা সরেজমিনে দেখে এসে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি জানান যে এ আন্দোলনে গুলি খেয়ে যাদের মৃত্যু ঘটেছে তাদের মধ্যে অধিকাংশরাই ৭.৬২ বোরের অত্যাধুনিক অস্ত্রের গুলিতে মারা গিয়েছেন কিন্তু এধরনের অস্ত্রের ব্যবহার এদেশে সম্পুর্ন নিষিদ্ধ এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এসব অস্ত্র কখনোই ব্যবহার করে না!
হতভম্ব হয়ে যায় সাধারণ মানুষ! সকলের মনে প্রশ্নের উদয় হয়, ‘তাহলে কারা সকলের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে নির্বিচারে অগণিত মানুষ হত্যা করেছে?’
তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনের মুখ থেকে এ তথ্যটি জানার পরে দেশের মিডিয়া তথা গণমাধ্যম মিথ্যাচারের অপরাধে সাধারণ মানুষের কাছে পুনরায় আস্থা হারিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর উপরে মিডিয়া ও সমন্বয়কদের আরোপিত মিথ্যা কলঙ্কের বোঝাও কিছুটা লাঘব হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের এই অসামান্য অবদানের কারণে জণগণ চির কৃতজ্ঞ। এই সাহসী ফৌজির কারণেই সকলের সেবক ‘বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সকল হত্যাকান্ড চালিয়েছে’ মিডিয়ার দেয়া এহেনো মিথ্যা অপবাদের দায়ভার থেকে মুক্তি লাভের পাশাপাশি ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধের অপরাধী হওয়া থেকে রক্ষা পায় সাধারণ মানুষকে যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো পরিস্থিতিতে সহায়তা দানকারী বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী কিন্তু তার আগেই অকারণে অগণিত পুলিশ সদস্যদের প্রাণ দিতে হয়েছে একটি পক্ষের হাতে যা ইতিহাস থেকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।
একথা এখন সবার জানা, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গণভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নিতে ৫ আগষ্ট সারা বাংলাদেশের মানুষ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়, এদিকে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে দেশত্যাগ করেন, আর দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছরের আওয়ামী সরকারের শাসনামলের অবসান ঘটে।
তখন আপাতত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব ও একটি সুষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতা হস্তগত করেন এ আন্দোলনের সমন্বয়কদের সমর্থনে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ প্রাপ্ত নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুস।
এর কিছুদিন পরেই জানা যায় আরেক ঘটনা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরে গণমাধ্যমের সুবাদে দেশের সাধারণ মানুষের সামনে আসতে থাকেন একে একে নতুন নতুন কিছু তরুণ মুখ, যারা এই আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড খ্যাত সমন্বয়কবৃন্দ বলে আত্মপ্রকাশ করেন এবং এছাড়াও তারা জানান যে আসলে তারা সকলেই দলীয় তথা শিবিরের সদস্য। নিজেদের পরিচয় গোপন করে নির্দলীয় ব্যানারে এই আন্দোলন তারাই পরিচালনা করেছেন তাদের প্লান-প্রগ্ৰামের উপর ভিত্তি করে।
এছাড়াও তারা জানান যে এই আন্দোলনে যতো ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড ঘটে, এমনকি পুলিশ বাহিনীর সাথেও যা যা ঘটেছে তার সকল সিদ্ধান্ত ছিলো একমাত্র তাদের এবং তারা প্রতিটি বিষয়ের দায়ভার কাঁধে তুলে নিয়ে দেশের মানুষকে জানান যে এসবকিছুতেই ছিল তাদের সৃষ্টি করা পরিস্থিতি যা এই আন্দোলনের কৌশল বলে তারা গণ্য করেন।
এরপরে একে একে ঘটতে থাকে আরোও বেশকিছু বিছিন্ন ঘটনা। যেমন, এ আন্দোলনে মৃত্যু ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক ব্যক্তিদের পরবর্তীতে আবার জীবিত মিলে। এছাড়াও একাধিক মৃত্যুর কারণ, এমনকি এই আন্দোলনে আসলে কে বা কারা এই বিশাল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, আসলে কতো লোকের মৃত্যু ঘটে তা নিয়ে সকলের মনে প্রশ্নের জন্ম নেয় যার উত্তর এখনও সাধারণ মানুষের কাছে শতভাগ অজানা।
কিন্তু সাধারণ মানুষ চায়, এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড কে বা কারা সরেজমিনে করেছেন তার একটা সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক। তবে এ আন্দোলনের মাষ্টার মাইন্ড খ্যাত সমন্বয়কবৃন্দ জানান যে এটা আন্দোলন নয় এটা ছিল বিপ্লব এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের প্রয়োজনে যেখানে যা কিছু করার দরকার ছিলো তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে এ সবকিছু করিয়েছেন। তারা মনে করেন, দেশ এখন স্বাধীন, সাধারণ মানুষ তাদের কাংখিত মুক্তি লাভ করেছেন, যারা মারা গিয়েছেন তাদের সবাইকে শহীদ বলে ঘোষণা করে সকল তদন্ত বন্ধ করে দেয়া হয় তাদের ইচ্ছায় এবং তারা সকলকে অবগত করেন যে নতুন করে দেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজে হাত দিয়েছেন তারা, সবাই যেনো ধৈর্য্য ধারণ করেন।
একপর্যায়ে দেখা যায়, তাদের এই দেশ গড়ার পথে রাষ্ট্রীয় সংবিধান দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়, তখন তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দেশের জাতীয় সংবিধানও বাদ দিয়ে দেন এবং দেশের জন্য নতুন করে সংবিধান রচনা করা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে বিবৃতি প্রদান করেন। এক্ষেত্রে তারা দেশের সকল মানুষকে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আহ্বান করেন তাদের সাথে থাকতে এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গঠন করার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে, অন্যথায় তারা বাধ্য হবেন আবার রাজপথে নেমে আবার আরেকটা বিপ্লব ঘটাতে, প্রয়োজনে তারা স্বশস্ত্র হয়ে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন আত্মপ্রকাশ ঘটাবেন, যার জন্য তাদের পুর্ব থেকেই সকল প্রস্তুতি রয়েছে।
এছাড়াও আন্দোলনের সমন্বয়করা মনে করেন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়েছে এটা ঠিক নয়, আর গত ৫৪ বছর ধরে এদেশে যা যা কিছু ঘটেছে তার সবকিছুই ছিল ভুল মানুষের ক্ষমতায়িত হয়ে ভুল পদক্ষেপের ফসল। তাই তারা সব ইতিহাস মুছে দিয়ে প্রয়োজনে জাতীয় সঙ্গীতসহ সবকিছু নতুন করে রচনা করবেন, তারাই এদেশের সঠিক ও একমাত্র যোগ্য নীতি নির্ধারক বলে মনে করে, তাদের হাতেই এই দেশ ও জাতি সঠিক পথ খুঁজে পাবে, -এই আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করে সকলের কাছে সহযোগিতা কামনা করেন, অন্যথায় তারা বাধ্য হবেন পুনরায়…
ওদিকে এ আন্দোলন যখন চলছিলো তখন হঠাৎ আলোচ্য মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করেন। যে ভিডিওটিতে দেখা যায়, মুগ্ধ আন্দোলনকারীদের হাতে পানি তুলে দিচ্ছেন….। মুহুর্তেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। দেখতে না দেখতেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে মেধাবী শিক্ষার্থী মুগ্ধ গুলি খেয়ে মারা গিয়েছেন, যদিও বড়ো ভাই দীপ্তর প্রকাশিত ওই ভিডিও ক্লিপটি ও মুগ্ধ মারা গিয়েছেন, -এই তথ্যটি প্রকাশ করা ছাড়া মুগ্ধ বিষয়ক আর কোনো তথ্য উপাত্ত হাজির করতে পারে নি গনমাধ্যম। ফলে মুগ্ধর মৃত্যু সকলের কাছে রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে এখনও এবং এ নিয়ে নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বিভিন্ন মহলে।
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরে আন্দোলনে যাদের মৃত্যু ঘটে তাদের সবাইকে (পুলিশ ছাড়া) শহীদ বলে ঘোষণা করে তাদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। বর্তমানে এই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধুনায় গণমাধ্যমের সামনে এসে মুগ্ধর যমজ ভাই বলে আত্মপ্রকাশকারী মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ কিন্তু এটা দেখে সাধারণ মানুষ আরেক ঘোরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছেন! কেননা মৃত্যুর পরে গণমাধ্যমে মুগ্ধর আদ্যপান্ত প্রকাশ করেছে যে মিডিয়া সেই মিডিয়া এটাও প্রকাশ করেছে যে স্নিগ্ধদের পরিবারের সদস্য বলতে কে কে আছেন? কে কি করেন কিন্তু সেখানে কোথাও বলা হয়নি যে মুগ্ধর একজন জমজ ভাইও ছিলো। যে আজ জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
(তথ্যসূত্র: Bangla Tribune)