নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘ইয়াবা ডন’ বলে কুখ্যাত আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক ইমরান হোসেন জানান, কক্সবাজারের টেকনাফে হত্যাচেষ্টা মামলায় আব্দুর রহমান বদিকে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। বদির বিরুদ্ধে এর আগে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে। এ বিষয়ে ঢাকায় র্যাব সদরদপ্তর থেকে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানান হয়েছে।
উল্লেখ্য কক্সবাজারের টেকনাফের ইয়াবা সাম্রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে বদি ও তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন বদি। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তিনি। তবে এ দুই নির্বাচনে তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন।
মাদক চোরাকারবারে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় বদির নাম আছে। এ তালিকায় গডফাদার হিসেবে বদির চার ভাইসহ পরিবারের অন্তত ২৬ জনের নাম রয়েছে।
গত মে মাসে নির্বাচনী বিরোধের জের ধরে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আলমকে লক্ষ্য করে গুলি করার অভিযোগ ওঠে বদির বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় জিডি করেছিলেন নুরুল আলম।
মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবা আনার অন্যতম রুট টেকনাফ। অভিযোগ রয়েছে, বদির পৃষ্ঠপোষকতায় ইয়াবা কারবার চলতো। বদির ভাই ও আত্মীয়স্বজন নিয়ন্ত্রণ করেন ইয়াবা আনার রুট। ক্ষমতার প্রভাবে ইয়াবা গডফাদাররা সব সময় থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এলেও তারা প্রকাশ্যে ইয়াবার রাজ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইয়াবা কারবারিরা এতটাই প্রভাবশালী, আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বিষয়টি তুলতেও কেউ সাহস করেন না।
২০০২ সালে টেকনাফ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন বদি। ২০০৮ সালে কক্সবাজার-৪ আসনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। জনপ্রতিনিধি হওয়ার ২৩ দিনের মাথায় টেকনাফ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর করেন। তাঁর হাতে হেনস্তার শিকার হন টেকনাফের বন বিভাগের কর্মকর্তা। ভোটার তালিকা তৈরা করাকে কেন্দ্র করে একজন স্কুল শিক্ষক তাঁর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। এরপর জড়িয়ে পরেন টেন্ডারবাজি, জমি দখল, চাঁদাবাজিতে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হন তিনি। এর পর থেকে চোরাচালান, ইয়াবা কারবার, মানব পাচারসহ রোহিঙ্গা আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে জড়ান নানা অপকর্মে। ইয়াবাকাণ্ডে বদিকে নিয়ে বিতর্ক উঠলে পরের নির্বাচনে ওই আসনে তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তারকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এমপি থাকার সময়ে ১০ বছর নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত নাম আবদুর রহমান বদি। ভাই, স্ত্রী, মামা, ভাগিনাসহ স্বজনদের নিয়ে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগেই বেশি সমালোচিত তিনি। এমনকি অবৈধ সম্পদের অভিযোগে দুদকের করা দুর্নীতির মামলায় সাজাও হয়।
অভিযোগ আছে, টেকনাফের ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করে বদির পরিবারই। বদির পরিবারের ইয়াবা সিন্ডিকেট সদস্যরা হলেন এমপি বদির আপন ভাই মো. আবদুল শুক্কুর, মজিবুর রহমান ওরফে মুজিব কমিশনার, শফিকুল ইসলাম, সৎভাই আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান, ভাগিনা আবদুর রহমান দারোগার ছেলে নিপু, শাহেদ কামাল, এমপির মামা হায়দার আলী ও এমপির মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল। তারাই পুরো টেকনাফ স্থলবন্দর দখল করে রাজত্ব করেন। এ ছাড়া ইয়াবা পাচারে ব্যবহৃত গাড়ির তালিকায়ও রয়েছে বদি পরিবারের গাড়ির নাম। এদিকে বদিকে গ্রেপ্তারের খবরে টেকনাফের মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে বলে জানিয়েছেন এলাকার লোকজন। সুত্র জানায়, মুহূর্তে এ খবর সীমান্তজুড়ে ছড়িয়ে পরে।
এ বিষয়ে টেকনাফের একাধিক বাসিন্দারা জানান, ‘বদি ইয়াবা সম্রাট। তাঁর কারণে দেশজুড়ে মাদক ছড়িয়ে পরেছে। বদি এবং তাঁর স্ত্রী এমপি থাকাকালীন প্রভাব খাটিয়ে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। বিশেষ করে মাদক চোরাচালান ও স্বর্ণ পাচারে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন। বদি অবৈধ টাকায় দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন।