IMG 20240823 WA0006

সোহাগ হাওলাদার : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানান কল রেকর্ড ফাঁসের মাস্টারমাইন্ড সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান। এছাড়া আয়নাঘর তৈরিসহ অসংখ্য ব্যক্তিকে গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছেন তিনি। তথ্য প্রযুক্তি খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং সজীব ওয়াজেদ জয় সিন্ডিকেট। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও আমেরিকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পলকের স্ত্রী কণিকা। অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে ছাত্র হত্যার জন্য দায়ী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে আছেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক আইন মন্ত্রী আনিসুল হক, শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ আরও কয়েকজন। রিমান্ডে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস, ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা পক্ষিগত করতে আয়না ঘর কনসেপ্ট তৈরি, শাপলা চত্বরে আক্রমণ, হত্যাযজ্ঞ চালানো, বিশেষ উদ্দেশ্যে আড়ি পাতার যন্ত্র পেগাসাস সফটওয়্যার কেনা, অসংখ্য ব্যক্তিকে গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ রয়েছে সদ্য চাকরি হারানো মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে। আট দিনের রিমান্ডে আছেন মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকার বিরোধী ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, সমালোচকসহ অসংখ্য ব্যক্তি গুমের শিকার হন। এমন সব ঘটনার পেছনে যাদের হাত রয়েছে জিয়াউল আহসান তাদের মধ্যে অন্যতম একজন।

এছাড়াও গোপন বন্দিশালা আয়নাঘর তৈরি করে বিভিন্ন মতাবলম্বীদের তুলে নিয়ে বছরের পর বছর আটকে রাখার অভিযোগও রয়েছে জিয়াউল হাসানের বিরুদ্ধে। ২০২২ সাল থেকে ন্যাশনাল টেলি কমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। এ সময়ে একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেছেন। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড তার নির্দেশেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হতো।

জিয়াউল স্বীকার করেছেন তার কাছে সব ধরনের নির্দেশ আসতো শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাছ থেকে। কল রেকর্ড ফাঁস, গুম, খুন ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথেও জড়িত শেখ হাসিনার উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক। তার নির্দেশে এসব করতেন মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। রিমান্ডে মুখ খুলতে শুরু করেছেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক।

পলকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ রেহেনার ছেলে, রেদওয়ান সিদ্দিক ববি, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমসহ সিআরআই সিন্ডিকেট দুর্নীতির মহা উৎসব চালিয়েছে। এদের মাধ্যমে প্রচার হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। জুনায়েদ আহমেদ পলকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সজীব ওয়াজেদ জয়ের সিগন্যাল ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কোন কাজই হতো না। জয়ের নির্বাচিত কোম্পানি থেকেই কেনা হতো সব যন্ত্রপাতি এবং সফটওয়্যার। জয়ের পক্ষ থেকেই পলকের সাথে সিআরআই এর কর্মকর্তারা মিটিংয়ে বসতেন মাঝে মাঝেই। পলকের হুমকিতে ছাত্র আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ রেখেছিল বিটিআরসি এবং বেসরকারি মোবাইল নেটওয়ার্ক সংস্থাগুলো। সরকারি এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার কোম্পানির কর্মকর্তাদের জয়ের নামে ভয় দেখাতেন পলক। এর বাইরে নিজস্ব সিন্ডিকেটও রয়েছে পলকের। ডিজিটাল বাংলাদেশ এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইটেক পার্ক, আইটি পার্ক তৈরির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে পলক সিন্ডিকেট।

শুধু পলকই নয় হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কণিকা। তবে তদন্তকারীদের ভাষ্যমতে এখনো অনেক কিছুই লুকাচ্ছেন সাবেক এই আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। রিমান্ডে থাকা আরো দুজন হলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান। সরকারি সব অপকর্মকে আইনি বৈধতা দিতেন আনিসুল হক। এছাড়া হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজার, ব্যাংক লুটের সাথে জড়িত সালমান এফ রহমান। রিমান্ডে প্রথম দিনের জিজ্ঞাসাবাদে তারা দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরির জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উপর দোষ চাপিয়ে দেন। ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আনিসুল হক সমাধানের দিকে যেতে চাইলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও সাবেক সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। আন্দোলন দমনে খুবই আক্রমণাত্মক ছিলেন তারা।

এছাড়া অন্যান্য প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ সময় শুধু হেসেছেন আনিসুল হক, বলেছেন শেখ হাসিনা আমাদেরকে যে গাইডলাইন দিয়েছেন আইনমন্ত্রী হিসেবে আমি শুধু সেই গাইডলাইন ফলো করেছি মাত্র। হত্যা আমলায় কেন তাকে রিমান্ডে আনা হয়েছে সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। যারা সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছিল তাদের ধরার পরামর্শ দেন আনিসুল হক। অন্যদিকে এখনো মানসিক ট্রমার মধ্যে আছেন সালমান এফ রহমান। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে এত তাড়াতাড়ি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে থাকা সংশ্লিষ্টকারীদের কাছে জানা গেছে পাকিস্তানে বেড়ে ওঠার কারণে ঠিকমতো বাংলাও পড়তে পারেন না তিনি। তবে তিনিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে, দেশে অরাজকতা ও রাজনৈতিক সহিংসতার দায় স্বীকার করেছেন।

রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন তারা। মূলত দুটি টিমের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের। একটি টিমে আছেন নিউমার্কেট থানার ওসির নেতৃত্বে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ জুনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা থানা পুলিশের সদস্য। অপর একটি টিমে রয়েছেন ডিএমপি সদর দপ্তর এবং ডিবির কর্মকর্তারা। এই টিম করা হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। তবে প্রভাবশালী এসব অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদে নিজেরাই ভয় পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তাদের অনেকেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *