116039202 mediaitem116039200.jpg

বিশেষ প্রতিবেদন : আমি আমার জাতির ইতিহাসের কথা বলছি, আমি আমাদের পুর্ব পুরুষের কথা বলছি। আমি এখনও আমার পুর্ব পুরুষের নাম কপালের ঘামের মতন মুছে ফেলতে পারি নাই…

৭১-এর মাঝামাঝি সময়। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবি, সবাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের খবরাখবর রাখছেন। প্রতিদিনের ঘটনাপঞ্জি নিয়ে নানান বিশ্লেষন করছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর সাফল্যের খবরে তারা আনন্দিত। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থতার খবরে তারা উদ্বিগ্ন।

এমনই একদিন কলকাতার বুদ্ধিজীবি মহলে রটে গেল পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করবে। সব আয়োজন সম্পন্ন। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় প্রথম খবরটা পেয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরা গড়ের মাঠে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকেন। সেখানে গিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আহবান জানানো হয় অন্নদাকে। বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গের প্রতি অন্নদার ছিল গভীর ভালোবাসা আর আবেগ। তাঁর জন্ম যদিও পূর্ববঙ্গে নয় কিন্তু তার দুটি সন্তানের জন্ম এখানে। আর জীবনের দুটি ভাগ তিনি কাটান পূর্ববঙ্গে। তো গড়ের মাঠে যাওয়ার জন্য বাড়তি টান ছিল তাঁর, গেলেনও কিন্তু এত ভিড় ছিল তিনি ভিতরে পৌছাতেই পারলেন না। তখন তার বয়স ৭০ এর কাছাকাছি।

বাসায় ফিরে এসে তার লেখার খাতাটা নিয়ে বসে যে বক্তব্যটি তিনি দিতে পারেন নাই তা কবিতায় রুপ দিলেন,

“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা

গৌরি মেঘনা বহমান,

ততকাল রবে কীর্তি তোমার

শেখ মুজিবুর রহমান

দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা

অশ্রুগঙ্গা বহমান

তবু নাহি ভয় হবে হবে জয়

জয় মুজিবুর রহমান।”

প্রিয় দেশবাসী ও আমার বন্ধুরা এবং এই ২০২৪ সালের বাঙালী জাতির জীবনে স্বর্নালী স্বাধীনতার কালপুরুষ সমন্বয়কদের কাছে আমার প্রশ্ন, “যে মানুষটা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন একজন পাগলা ভোলা দেশ আর বাঙালী প্রেমিক। যে মানুষটার সাথে তাঁর নিজ-দল আওয়ামী লীগের নেতারা বেঈমানি করে স্বপরিবারে হত্যা করে, তাঁর নাম ও নিশানা মুছে ফেলতে দুধের শিশু রাসেলকেও ছাড়ে নাই কিন্তু তবুও পৃথিবীর মানব ইতিহাসের নক্ষত্র শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয় নাই বরং পৃথিবীর দেশে দেশে তাঁর নামে জন্ম দেয়া হয়েছে অগণিত রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান কিন্তু এবার এই স্বাধীনতা যুদ্ধে কারা সেই বাঙালী জাতির অদ্বিতীয় ইতিহাসকে অপমানিত করেছে? সারা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর মানুষ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছে বাঙালী জাতির হাতে আরোও একটি নেককাজ জনক ইতিহাস! যারা এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ছিলো তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কেউ কিছুই বললেন না? আপনারাও তো বাঙালী‌ই তাই না? আপনারা কি আপনাদের পুর্ব পুরুষের নাম কপালের ঘামের মতন মুছে ফেলতে চান?”

আমি তো মনে করি একটি ১৯৫২ এসেছিল বলেই একটি ১৯৭১-এর জন্ম হয়েছে আর একটি ১৯৭১ জন্ম নিয়েছিলো বলেই আজ একটি ২০২৪-এর জন্ম। আমরা যদি ৫১, ৭১-এর ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চাই বা কেউ চাইলে আমরা যদি তা নিরবে মেনে নেই তবে একদিন আমাদের এই প্রজন্মের এবারের এই স্বাধীনতাকেও যে মুছে ফেলবে না তাই বা কে বলেছে!?

সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, এদেশের দলমত নির্বিশেষে প্রায় সকলেই সহ সারা পৃথিবীর সবাই মানেন ও জানেন যে বঙ্গবন্ধু মানে আওয়ামীলীগ বা শেখ হাসিনা না। বঙ্গবন্ধু মানে একটি মানব ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস। তাহলে কি করে এই ঘটনা ঘটে আর কি করে তা দেখার পরেও সবাই চুপচাপ মেনে নিতে পারে? এই নিরবতা আমাদের মেধাবীদের পৃথিবীর মানুষের কাছে কোন স্তরে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে তা কি তাঁরা কেউ ভাবেনি!? এখানে তাঁকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করলেই কি পৃথিবী থেকে তাঁর ধ্বংস নিশ্চিত করা যাবে? নাকি পৃথিবীর কোনো মানুষকে আমরা তোয়াক্কাই করি না?

বিদেশে বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে সড়কঃ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ, বঙ্গবন্ধু মঞ্চ, বঙ্গবন্ধু ভবন, বঙ্গবন্ধু স্কুল, বঙ্গবন্ধু স্মারক জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু চেয়ার, বঙ্গবন্ধু বৃত্তি, বঙ্গবন্ধু কর্নার ছাড়াও রয়েছে একাধিক সড়ক, সরণি, ওয়ে, লেন ও স্ট্রিট।

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লেন, কলকাতায় শেখ বঙ্গবন্ধু সরণি, কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে শেখ মুজিবুর রহমান রোড, মিশরের আংকারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুলবার্ড, ফিলিস্তিনে মুজিব স্ট্রিট, মরিশাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্ট্রিট, আমেরিকার শিকাগোতে শেখ মুজিব ওয়ে এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে ‘In Memory of Sheikh Mujibur Rahman’ ইত্যাদি, সব মিলিয়ে সাত-আটটি স্মৃতি সড়ক রয়েছে।

কলকাতা-দিল্লি: বঙ্গবন্ধুর নামে দেশের বাইরে প্রথম সড়ক নামকরণ করা হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৭ সালে পার্ক সার্কাস রাস্তাটিকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরণি’তে নামান্তর করেন। কলকাতাস্হ বাংলাদেশ উপদূতাবাসের সামনে শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে অবস্হিত এই সড়কটি। যার দূরত্ব-দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটার।

অন্যদিকে দিল্লি শহরের পৌর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে নয়া দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে শঙ্কর রোড-মন্দির মর্গ ট্রাফিক চত্বর থেকে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী মাদার তেরেসা ক্রিসেন্ট পর্যন্ত পার্ক স্ট্রিটের একাংশের নাম বদলে রাখা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সড়ক। যেটি আওরঙ্গজেব রোড নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিল।

কম্বোডিয়া: গণহত্যার শিকার হওয়া দুই দেশ বাংলাদেশ ও পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার একে অপরের জাতির পিতার নামে গুরুত্বপূর্ণ শহরের প্রধান সড়কের নামকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

দুই দেশের বন্ধুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনের একটি প্রধান সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শেখ মুজিবুর রহমান রোড’ নামে আর রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক জোনের অন্যতম প্রধান সড়ক বারিধারা পার্ক রোডের নাম পরিবর্তন করে কম্বোডিয়ার জাতির জনক ও সাবেক রাজা নরোদম সিহানুকের নামে করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ।

ফিলিস্তিন: ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি সড়কের নামকরণের সিদ্ধান্ত নেয় ফিলিস্তিন সরকার। পরে দেশটির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহর হেভরনের একটি রাস্তার নাম বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ করা হয়।

মরিশাস: মরিশাসের প্যারাডাইজ আইল্যান্ডের রাজধানী পোর্ট লুইসের একটি সড়ক বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ হয়েছে ২০২০ সালে।

মরিশাসে অবস্হিত বাংলাদেশ হাইকমিশনার এবং মরিশাসের দ্য সিটি কাউন্সিল অব পোর্ট লুইসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্ট্রিট’ উদ্বোধন করেন ২০২০ সালের বিজয় দিবসে।

তুরস্ক: তুরস্কের রাজধানী আংকারায় ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়। রাস্তাটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুলবার্ড’।

এছাড়া তুরস্কের অন্যতম প্রধান শহর ইজমিরে বঙ্গবন্ধুর নামে আরেকটি সড়ক রয়েছে। উল্লেখ্য, আংকারায় বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশেই বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ডেভন অ্যাভিনিউ’র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নামকরণ করে ‘শেখ মুজিব ওয়ে’। শিকাগো সিটি কাউন্সিলের উদ্যোগে ২০১৮ সালে এ নামকরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে যুক্তরাষ্ট্রে এটি প্রথম উদ্যোগ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু সাবওয়ের নামকরণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে একটি মহাসড়কে শোভা পাচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ডাউন টাউন থেকে যে Adopt A Highway সংযুক্ত হয়েছে, সেই রাস্তার একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘In Memory of Sheikh Mujibur Rahman’। ফলে হাজার হাজার যানবাহন চালক এবং আরোহীদের আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে কে এই ব্যক্তি!

আমেরিকায় বেশ কয়টি স্হানে মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর ভাস্কর্য রয়েছে। সেই ধারণা থেকে বাংলাদেশি শওকত চৌধুরী লস অ্যাঞ্জেলেসের Varmont এবং 4th St. এ ‘শ্যাটো রিক্রিয়েশন পার্কে বঙ্গবন্ধুর একটি মু্যরাল এবং একটি বেঞ্চ স্হাপনের উদ্যাগ নেন। সেজন্য মু্যরাল এবং পার্ক বেঞ্চ ডোনেট হিসেবে বেশ কয়েক হাজার ডলার খরচ পড়বে। নানান জটিলতার কারণে সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে হাইওয়েতে এই বিজ্ঞাপন বোর্ডে বঙ্গবন্ধু নামের সিদ্ধান্ত নেন এবং তিন মাইলব্যাপী দীর্ঘ এই জায়গায় পাঁচ বছরের জন্য CALTrans সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। যার বিনিময়ে ফ্রি ওয়ের পাশের দুই মাইল স্হান পর্যন্ত মাসে দুই বার পরিষ্কারকরণের কাজে ব্যয় করতে হবে। পরে নির্ধারিত স্হান 101 Free Way’i S. Silver Lake Blvd. থেকে 101 & 110 Intersection পর্যন্ত বরাদ্দ পান জুলাই ২০১৭ থেকে।

এছাড়া জার্মানি, রোমানিয়া ও ওয়াশিংটনে বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক করার প্রস্তাব রয়েছে এবং প্রস্ত্ততি চলছে।

এমতাবস্থায় আমার প্রশ্ন সারা বিশ্বের কাছে নিজেদের নিজেরাই খাঁটো করার এই নোংরা প্রবৃত্তির বিষয়ে অবশেষে কি হবে? নিজেদের অপকর্মে নিজ জাতির এই জঘন্য ইতিহাস কি আমরা এভাবেই এড়িয়ে গিয়ে মেনে নেবো? কি কারণে? কার মন রাখতে!?

সাফকথা নিউজ

(তথ্যসুত্র

একটি ভিডিও লিংক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *