নিজস্ব প্রতিবেদন : আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পান আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আবু বাকের মজুমদার, আসিফ মাহমুদ ও নুসরাত তাবাসসুম এই ছয় সমন্বয়ক।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা সকলেই। এদের মধ্যে চারজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টের মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। বাকি দুজনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ফেসবুক পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেছেন-
‘এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই মুক্ত নই। এই গণগ্রেপ্তার গণঘৃণার নামান্তর। আমাদের মুক্তি তখনই সম্পূর্ণ হবে, যখন এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটিও মুক্তি পাবেন। এই গণগ্রেপ্তার কেবল নিরপরাধ মানুষের অধিকার হরণ নয়, বরং আমাদের সমগ্র সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন। এটি মুক্তচিন্তা ও মানবাধিকারের প্রতি এক ভয়ানক আঘাত।’
তিনি আরও লিখেন,
‘আমাদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র ব্যক্তির মুক্তির জন্য নয়; বরং বৈষম্য, নিপীড়ন, গণগ্রেপ্তার এবং ছাত্র নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শেষ ব্যক্তিটি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’

আন্দোলনের আরেক অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন-
‘কথা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করবেন না, মামলা দিয়ে হয়রানি করবেন না। আপনারা কথা রাখেননি।
আপনারা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর আঘাত করেছেন। সারা দেশে আমার স্কুল-কলেজের ভাইবোনদের ওপর লাঠিচার্জ করেছেন৷ যাকে ইচ্ছা তাকে জেলে পাঠিয়েছেন। আন্দোলনকারীকে খুঁজে না পেলে বাসা থেকে ভাইকে তুলে নিয়েছেন, বাবাকে হুমকি দিয়েছেন! মাশরুর তার উদাহরণ।
যারা একটিবারের জন্যও এই আন্দোলনে এসেছে তারা শান্তিতে ঘুমাতে পারে না, গ্রেপ্তারের ভয়ে থাকে৷ এমন অনেকে আছে যাদের পরিবার এখনও তাদের খোঁজ পায়নি। এমন তো হওয়া উচিৎ ছিল না!’
এছাড়াও তিনি লিখেছেন, ‘কোথায় মহাখালীর সেতু ভবন আর কোথায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়! অথচ আপনারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে মহাখালীর সেতু ভবনে হামলার জন্য গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলেন। সাথে আছেন আসিফ মাহতাব স্যার, মাশরুরসহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য শিক্ষার্থী।
রিকশা থেকে নামিয়ে প্রিজন ভ্যানে তুলছেন, বাসা থেকে তুলে নিয়ে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন৷ আমার বোনদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছেন। কী ভাবছেন? এভাবেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে?’
তিনি আরও লিখেছেন,
‘৬ দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ৬ জনকে আটকে রাখা যায়। কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে আটকে রাখবেন? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত সেগুলো কীভাবে নিবৃত্ত করবেন?
পুলিশ ভাইদের উদ্দেশে একটা কথা বলি। এ দেশের মানুষের ক্ষোভ আপনাদের ওপর নয়, পুলিশের ওপর নয়। এই ক্ষোভ আপনার গায়ের ওই পোশাকটার ওপর। যে পোশাকটাকে ইউজ করে বছরের পর বছর আপনাদের দিয়ে এ দেশের অসংখ্য মানুষকে দমন-পীড়ন করা হয়েছে, অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে, জেল আর আদালতের প্রাঙ্গণে চক্কর কাটানো হয়েছে, সেই পোশাকটার ওপর। ওই পোশাকটা ছেড়ে আসুন আমাদের সাথে, বুকে টেনে নেব।
এ পথ যেহেতু সত্যের পথ, ন্যায়ের পথ, তাই যেকোনো কিছু মোকাবিলা করতে আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত নই৷ যতদিন না এ বাংলাদেশ আন্দোলনকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে; গণগ্রেপ্তার, জুলুম, নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে; ততদিন এ লড়াই চলবে।’

সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ লিখেছেন-
‘বেআইনিভাবে আটক রাখা থেকে মুক্তির দাবিতে গত মঙ্গলবার রাত থেকে ৩২ ঘণ্টা আমরণ অনশনে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদার। এ সময় তারা কোনো প্রকার খাবার, পানি ও চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সমন্বয়কদের অনশনের মুখে আজ দুপুর ১টার দিকে ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’

এছাড়াও নুসরাত তাবাসসুমের ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন তার ফুফাতো বোন মেহের আফরোজ। নুসরাতের ফেসবুক থেকে তিনি লিখেছেন-
‘নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি অফিস থেকে ফেরত পেয়েছি আমরা। ৩২ ঘণ্টা অনশনের ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে নুসরাত দুর্বল। সে বর্তমানে কারও সাথে যোগাযোগ করার অবস্থায় নেই। সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে নুসরাত তাবাসসুম আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবে। সকল প্রতিবাদী কণ্ঠকে আপনাদের দোয়ায় রাখবেন।’
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের এখনও নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাননি।
এর আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সমন্বয়কদের ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন ডিবি লালবাগের ডিসি মশিউর রহমান। তিনি বলেন, দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
তার আগে ভোর ৬টায় ডিবি কার্যালয় থেকে ফোন দিয়ে সমন্বয়কদের পরিবারকে ডেকে পাঠানো হয়।
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে প্রথমে নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকেরকে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নেয় ডিবি। পরদিন সন্ধ্যায় সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে নিয়ে আসে ডিবি। রোববার ভোরে মিরপুরের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তুলে আনা হয় নুসরাত তাবাসসুমকে। এরপর থেকে তারা মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে ছিলেন।
ডিবি দাবি করেছিল, সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে।