BFDC Gate

মঞ্জুর মোর্শেদ : একদা উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী মুভি ইন্ড্রাস্টি ছিল আমাদের বাংলাদেশে, যা আজ ধ্বংস হোতে হোতে অবক্ষয়ের তলানিতে এসে পৌঁছেছে, কিন্তু কেনো? এ কেনোর উত্তর খোঁজার থেকে অনেক বেশী জরুরী, এই ইন্ড্রাষ্ট্রির নষ্ট হওয়াই কি কি সমস্যা ও অসুবিধায় পরতে হয়েছে কপালপোড়া বাঙালী জাতির, তার একটা অংশ নিয়ে আজ আলোচনা করছি।

একটা দেশের চলচ্চিত্র সেই দেশের কথা বলার অন্যতম মাধ্যম, বিশ্বের কাছে পরিচিতি বৃদ্ধির উপায়, জাতিকে একটা ব্র‍্যান্ডিংয়ে নিয়ে যাবার অন্যতম সোপান। আমরা জানি যে কোন অচেনা দূর দেশ বা জাতির সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য উক্ত দেশের একাধিক মুভি দেখলেই সবাই ধারণা পায় এবং সবাই তাই করেও থাকেন।

🔘 এক্ষেত্রে, বাংলাদেশ সম্পর্কে কি করে ধারণা মিলবে?

🔘 আমাদের কথাগুলা আমরাই বা কোন মাধ্যমে প্রকাশ করবো?
🔘 এছাড়াও মনে করেন, কোন একটি দেশ বা জাতির মানুষ যদি আমাদের দেশ, জাতি বা ইতিহাস নিয়ে ভুল বা মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি মুভি তৈরি করে বা অপমানজনক ভাবে উপস্থাপন করে, তাহলে আমরা তার কাউন্টারে কিভাবে কি করব?

আমরা কি ফেসবুকসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করে পোস্ট লিখবো? কিন্তু তারপর একদা আমরা তো নিজে থেকেই থেমে যাবো, আর এটাই স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে ভুল বা মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা সেই মুভিটা কিন্তু থেমে যাবে না বরং থেকেই যাবে, যা পরবর্তীতেও তথা আজীবন সমান ভাবে ভুল তথ্য ছড়াতেই থাকবে। তাই নয় কি?

এমতাবস্থায় আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমরা যদি ওই ভুল বা মিথ্যা তথ্য ভিত্তিক মুভিটার প্রতিবাদে একই প্রকৃতির কিন্তু সঠিক ও মজবুত তথ্য ভিত্তিক অপর আরেকটি মুভি তৈরি করি, তাহলে প্রতিবাদটা কেমন হবে?

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমার

আমরা সেন্টপার্সেন্ট লোক এখন ভারতের ভাষা, গান হুবহু বলতে পারি, গাইতে পারি, বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার‌ও করি, এটা তাদের মুভির কল্যানেই বৈকি। তাদের মুভি দেখে বাঙালী অবচেতন বা চেতন মনে তাদের ফ্যাশন ফলো করছেন, ফলে তাদের ব্যাবসা বাড়ছে। তাদের দেশ, মানুষ, শহর, সেনা সব কিছু নিয়ে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারছে একমাত্র তাদের মুভির কল্যানে। তারা এখন পৃথিবীর কাছে একটা ব্র‍্যান্ড, অনুকরণীয়।

পাশাপাশি মায়ানমারের কথাটা ভাবুন। মায়ানমারের মুভি ইন্ড্রাষ্ট্রি শক্তিশালী নয়, তাই তাদের ফ্যাশন, কালচার কোনোকিছুই পৃথিবীর মানুষের মাথায় মাথায় জায়গা করে নিতে পারে নাই। তাদের লাইফস্টাইল সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষের কোনো ধারণাই নাই, অর্থাৎ সকলের মস্তিস্কের মানচিত্রে মায়ানমার অংশটা এজন্য‌ই এখনও কালো বা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে।

ঠিক একই ভাবে, একই কারনে বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থানটাও কালো বা অন্ধকারাচ্ছন্ন রয়ে গেছে। চাইলেও একজন বিদেশি আমাদের বা আমাদের প্রায় ছয় হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার ধারনা পায়না। চলচ্চিত্র শিল্প বেকার বলে আমরা আমাদের তুলে ধরতে পারছি না, পাশাপাশি কেউ যদি আমাদেরকে জংলী, অসভ্য বলে দেখিয়ে দেয় তবে সেটাই ঠিক হয়ে দাঁড়ায় কেননা দুর্বল চলচিত্র শিক্ষা সঠিক ভাবে নিজেদের কথা বলতে পারে না, সঠিক ধারণা দিতে পারে না…

লক্ষ্য করুন, ভারত তার মুভি ইন্ড্রাষ্টির মাধ্যমে পুরো দেশকে এক সুতায় বেঁধে রেখেছে। ‘মেরা ভারত মহান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারত তা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তুলে ধরতে ধরতে এখন সবাই জানে, সবাই মানে। এছাড়াও তাদের চলচিত্র দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধকে সমৃদ্ধশালী করতে সক্ষম হয়েছে ৷ তারা বছরের পর বছর, দশকের পর দশক তাদের সেনাবাহিনী, দেশপ্রেম, সামাজিক পরিস্থিতি, অগ্ৰগতি নিয়ে নিয়ে মুভি তৈরি করে করে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন যার বদৌলতে তাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে একটা আলাদা রকমের কোয়ালিটি তৈরি হয়েছে, পরিচিতি লাভ করেছে সারা বিশ্বে।

এ ক্ষেত্রে আমাদের কি পরিস্থিতি?

চলচ্চিত্র শিল্প একটি জাতির জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
(ছবি: প্রতীকী; সংগৃহীত)

আমাদের এতো এতো ইতিহাস, এতো এতো শ্রেষ্ঠ মানবের জন্ম, এতো এতো বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ যার কোনোকিছু নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন ভালো মুভি তৈরি করতে পারিনি আমরা। তাহলে দেশের দেশের জনগন‌ই বা কিভাবে কি জানবে? পরবর্তী প্রজন্ম কি করে বুঝবে যে বাঙালী মানেই দুর্নীতিবাজ নয়, কিভাবে অপরাধীদের মনে ভয়ের জন্ম হবে যে অপরাধ করলে ছাড় পাওয়া যায় না, কেনো পিয়নের পাঁচটা বাড়ি করতে গেলে কলিজা কেঁপে উঠবে, সর্বোপরি আমরা আইডল বলতে কাকে মনে নিবো? কি নিয়ে গর্ববোধ করবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম?

আপনি কি মনে করেন দল মতে ভাগ হয়ে এই সে নানান জনের নানান রকম মুখের কথা, বক্তৃতা, গপ্পোসপ্পো এগুলো শেষপর্যন্ত হালে পাবে? না পাচ্ছে!?

লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে আছে, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক তৈরি করতেও আমাদের বিদেশী পরিচালক বিদেশী সেট হায়ার করতে হচ্ছে, তাহলে ৫৪ বছরে আমরা কি করলাম? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী কালের ইতিহাস, সীমান্ত যুদ্ধ, বিদেশী আগ্ৰাসন, অধিকার হরণ নিয়ে কোন মুভি তৈরি হয় না, ছবি তৈরি করা হয় বখাটে সম্প্রদায়ের নষ্টামি নিয়ে রমরমা রম্য সিনেমা! আগের সেই পাল, সেন, শাহ, মুঘল বা বারভুইয়া নিয়ে কোন চলনসই মুভি তৈরি হয় না।

তাছাড়াও আমরা আমাদেরই বিকৃত ইতিহাস দেখছি ভারতের তৈরি করা বিভিন্ন মুভিতে। দেখার পরে কেউ প্রতিবাদ করে না, কোনো শিল্পীর মন চিৎকার করে বলছে যে এই অংশটা ঠিক নয়, এইটা ভুল, প্রতিবাদে কেউ কোনো মুভি বানায় না, তাহলে কি করে কি আশা করবেন?

আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন, ভারত ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশকে নিয়ে যে একটি চমৎকার মুভি তৈরি করেছে। মুভিটি তৈরি হয়েছে বলেই সবাই অপরিচিত চরিত্রটির সাথে পরিচিত হতে পেরেছে, সবাই তার সম্পর্কে এখন সব জানেন। ওদিকে লক্ষ্য করে দেখেন মুভিটিতে বাংলাদেশের অংশটা খুবই অবহেলার সাথে নির্মান করা হয়েছে, আশা করি কথাটায় কারো দ্বিমত নাই। অবাক কান্ড, মুভিটিতে আমাদের কোন নিয়মিত সেনাই দেখানো হয়নি, কিন্তু আসলেই কি তাই!?

আজ আমাদের‌ও শক্তিশালী মুভি ইন্ড্রাষ্ট্রি থাকলে আজ আমরাও জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে নিয়ে চমৎকার চমৎকার চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারতাম, যা দেখে বিশ্ববাসী বাঙালীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে যেতো বাধ্য হয়েই। আমাদের মুভি ইন্ড্রাষ্ট্রি যদি এভাবে শক্তি ও মেধার অভাবী না হয়ে যেতো তাহলে আমরাও কি পারতাম না ট্যাংক ব্যাটেল অব শিরোমণি, কিলো ফ্লাইট, বাবলা বাহিনী ইত্যাদিসহ অসংখ্য সত্য ঘটনা নিয়ে মুভি তৈরি করতে?
এতে করে দেশের মানুষ, পরবর্তী প্রজন্ম সবাই আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারতো এবং পৃথিবীর কোনদেশ আমাদের ইতিহাস বিকৃত করার সাহসই পেতনা, আপনি কি মনে করেন?

যা হবার হয়েছে, যা হারাবার হারিয়েছি কিন্তু এখনও আমরা আশাবাদী, এখনও আমরা স্বপ্ন দেখি, এখনও আমরা মনেপ্রাণে কামনা করি, আমাদের‌ও একটি শক্তিশালী চলচ্চিত্র শিল্প থাকবে। আমরাও আমাদের কালজয়ী কৃতিত্ব সবাইকে দেখাবো…

দুঃখের কথা কাকে বলবেন? আমাদের একটা বিএফডিসি আছে যার জন্ম দিয়েছে বঙ্গবন্ধু, তিনি এরজন্য সাথে গাজিপুরে একটা ফিল্ম সিটির জন্য জায়গাও বরাদ্দ করেছিলেন, ওরা ১১ জনের মতো সিনোমাও তৈরি হয়েছে কিন্তু কি দুঃখজনক কথা, ভালো মুভির অভাবে ৩০০০ সিনেমা হল কমতে কমতে এখন ২০০তে এসে নেমেছে।
আমরা দেখেছি, হলিউড দিয়ে বিশ্ব শাষন করছে পশ্চিমারা, বলিউড দিয়ে এশিয়া শাষন করছে ইন্ডিয়া, আর আমরা…!

ভারত একমাত্র সিনেমা দিয়েই দেশ ও জাতিকে অন্য রকম একটা উচ্চতায় নিয়ে গেছে এবং সিনেমা দিয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত করে পুরো ভারতের একত্বাতা বোধকে বেঁধে রেখেছে।

শিল্প সাংস্কৃতি একটি রাষ্ট্রের কেবলমাত্র মানদণ্ড ও পরিচয়‌ই বহন করে না, এর সাথে দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নও বিশেষ ভাবে জড়িত।

মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে ইরান কিভাবে এত শক্তিশালী হোলো? যেকোনো ইরানী একবাক্যে তাদের মুভি, শিল্প সাংস্কৃতির ভূমিকার কথা সবার আগে বলবে, আর আমরা? আমরা একটা ভিনজাতির আজীজ মোহাম্মদ ভাইকেই দ্বায়ী করবো নাকি আমাদের নিজেদের চারিত্রিক দুর্বলতাগুলো মাথায় নিয়ে শুধরানোর চেষ্টা করবো? বিচারটা আপনাদের কাছেই রাখলাম।

সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন এই কামনা ও দোয়া করি এবং ‘আমরা সবাই মিলে ভালো থাকতে চাই’, -এই স্বপ্নের কথা পুনরায় সবাইকে জানান দিয়ে আজকের মতো বিদায় নিলাম, শুভরাত্রি 🌹 🇧🇩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *