আতিউর রহমান

বিশেষ প্রতিবেদন :আতিউর রহমান” একজন বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ। ১ মে, ২০০৯ সালে তিনি বাংলাদেশ গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১৬ মার্চে তিনি সাইবারজাকিংয়ের মাধ্যমে উত্তরের রিভার অর্থ চুরির ফল প্রকাশের পর ১৫ মার্চ স্বচ্ছ পদত্যাগ করেন। অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখার কারণে তিনি বেশ পরিচিত। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষা তার লেখার সংখ্যা লেখা রয়েছে। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি ৩ই আগস্ট, ১৯৫১ইং পূর্বে দিপাড় ঘোলা, দিগপাই ইউনিয়ন, সদর থানা, জামালপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালী মান জন্য তিনি একটি জলন্ত উদাহরণ। মানুষের মতো মানুষের জন্য, মানুষের ইচ্ছা প্রধান হাত তার একটি বিশেষ পরীক্ষা।

“লেখাটা আগে ছেলেমেয়েদের পড়ান, তারপর আপনি নিজেই পড়ুন।”

উল্লেখ্য, টাকাই জীবন সব না। আর ইচ্ছা থাকলে, টাকা আপনার কাছে পেতে পারেন। টাকা, মান সম্মান, অর্জনের বিষয়৷

(অর্থনীতি ড. আতিউর রহমানের আমার নিজের জীবনের কথা)

আমার জন্ম জামালপুর এক অজপাড়াগাঁয়ে। ১৪ প্রশ্ন দূর সন্ধ্যা যেতে পারে হেটে বা সাইলে চড়ে। পুরো ব্যবসার মধ্যে মেট্রিক মেট্রিক ব্যবহার করতে চাচাফিজ পাস করছিলেন। আমার বাবা একজন উচ্চ দরিদ্র কৃষক। আমরা পাঁচ ভাই, তিন বোন। কোন বিষয়ে নিশ্চিত না দিন আমাদের।

আমার দাদার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি। কিন্তু তিনি আমার বাবাকে বাড়িতে ঠাঁই দেন। দাদার খানিকটা একটা ছনের বাড়ি আমরা এতগুলো ভাই-বোন আর বাবা-মা থাকতাম। মা তাঁর বাড়ি থেকে ছেলের অংশ পেয়েছিলেন। পার্টি তিন বিঘা জমি কেনা হয়। চাষবাদ অনুপযুক্ত টেবিলে অনেক কষ্টে বাবা যা ফলানের জন্য, অংশ পাঁচ/৬টা খাবার জুট। দারিদ্র্য কী জিনিস, তা আমি মর্মে উপলব্ধি করেছি- খাবার নেই, পরনের কাপড় নেই; কী এক অবস্থা!

আমার লেখা জানতে। তার কাছেই আমার শেয়ার ধর। তারপর পরবর্তী প্রক্রিয়া গঠন। কিন্তু আমার পরিবারে এত অভাব, আমি যখন তিন ভাগে উঠলাম, তখন আর মনে হয় সুযোগ থাকলো না। বড় ভাই আরো আগে স্কুল ছেড়ে যেতে বলেছে। আমাকে ছেড়ে দেওয়া পথের নাম।

আমাদের গাভী আর কয়েকটা খাসি ছিল। আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওগুলো চরাতাম। সপ্তাহের বেলা গাভীর দুধ নিয়ে যেতে। অন্য দুই ভাই যা কর তামাশা, কোন দিন কাটছিল। আবার ফরার পরের পণ্য থেকে সঞ্চিত আট টাকা আমি পান-বিড়ির দোকান দেন। সকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈঠক বসতাম। মনে হয় তুমি বন্ধ, আদৌ- সেই স্বপ্ন ছিল না!

এক ভাইকে বড় ভাই বললেন, আজ স্কুলের ভিডিও হবে। মনে আছে, তখন আমার মতো কোন জামা নেই। খালি গা আর লুঙ্গি পরে আমি ভাইয়ের সাথে দেখতে চাই। স্কুলে আমি যথেষ্ট বিস্ময়ে হতবাক! চার দিকে এত আনন্দময় পরিবেশ! আমার মনে হয়, আমিও তো আর সবার মতই হতে পারতাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে আবার স্কুলে ফিরে আসতে হবে।

আমাকে ফেরার পথে বড় ভাইকে বলে, আমি কি আবার স্কুলে ফিরে আসতে পারি? আমার ভঙ্গি বারুণ চাহনি সম্পর্কে কর অন্য কোন কারণে কথাটা ভাই মনে ধরলো। তিনি বললেন, ঠিক আছে কাল হেডসের সাথে আলাপ।

পরদিন দুই ভাই আবার স্কুলে। ভাই আমাকে হেডস্যার রুমের মধ্যে দাঁড় করিয়ে ভিতর বড় ভিতরের অংশে। আমি আশা করি সদস্য প্রতিনিধি শুনছি, ভাই বলেছেন আমাকে বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু হেডস্যার অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললেন, পাতা দিয়ে কি লেখাপড়া হয়! আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। যতখানি নিয়ে যাওয়া জোরের, আশা ধুকের এক কথা স্কুলে সব মিলে গেল। তবু বড় ভাই অনেক পীড়াপীড়ি করে আমার পরীক্ষা অনুমতি যোগাড় করার জন্য। খাওয়া তখন আর মাত্র তিন মাস বাকি। বাড়ি ফিরে মাকে, আমাকে তিন ছুটি দিতে হবে। আমি আর এখানে থাকবো না। কারণ উদাহরণ খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই- আমার কোন বই নেই, কিন্তু আমাকে পরীক্ষায় পাস করতে হবে

মা বললেন, যাবি? আমার এক কালের সহপাঠী এবং এখন ক্লাসের ফার্স্টবয় মোজাম্মেলের বাড়িতে যাবো। আমাদের আমার সঙ্গে আমার রাজনীতি আছে। যে ক’দিন কথা বলেছি, অনেক ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমাকে অনেক দিতে পারবে না।

দুরু দুরু মোজাম্মেলের বাড়ি মনে মনে। অনেক দেখতে বলতেই খালাম্মা সানন্দে রাজি। আমার খাবার আর আকাশ জুটলো; শুরু করা নতুন জীবন। নতুন করে শুরু করা। প্রতিক্ষণেই হেডস্যার সেই অজ্ঞাত কথা মনে পড়ে, জেদ কাজ করে মনে; আরো ভালো করে জানাই।

যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু করা। আমি এক-একটি পরীক্ষা শেষ করছি। আমার আত্মবিশ্বাসও হচ্ছে। ফল প্রকাশের দিন আমি স্কুলে গিয়ে প্রথম সারিতে বসলাম। হেডস্যার ফলাফল নিয়ে এলেন। আমি লক্ষ্য করতে, খুঁজে বের করতে গিয়ে তাকে বোঝানো হয়েছে। আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। তারপর ফল পাস। আমি প্রথম হয়েছি! খবরের বড় ভাই আনন্দে কেঁদে ফেললেন। শুধু আমি নির্বিকার-সংবাদ কথা ছিল।

বাড়ি ফেরার পথ সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আমি আর আমার ভাই গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে আসছি। আর পিছনে এক দল ছেলেমেয়ে আমাকে নিয়ে হাওয়া চৈ করছে, স্লোগান প্রস্তাব। খোলা গাঁয়ে সাড়া পড়ে গেল! আমার নিরক্ষর বাবা, যাঁর কাছে ফার্স্ট আর লাস্ট একই কথা- তিনিও আনন্দে আত্মহারা; শুধু এইটুকু বুঝলেন যে, ছেলে বিশেষ কিছু একটা করেছে। যখন শুনলেন আমি তার ওপর কাসে ফেলছি, নতুন লেখা, পরদিনই ঘরের খাসিটা হাতে নিয়ে গিয়ে ১২ টাকায় খুঁজে বের করতে হবে৷ তারপর আমার সাথে নিয়ে জামালপুর অনেকদিন। নতুন বই কিনলাম থেকে নবনুর লাইব্রেরি।

আমার জীবনযাত্রা এখন সম্পূর্ণ হয়েছে। আমি রোজ স্কুলে অবসরে পৃথিবীর কাজ করি। সীমান্তদের সুনজরে পড়ে গেছি। ফায়েজ মৌল ভয় আমাকে তাঁর সন্তানের মতো দেখাশুনা করতে লাগল। সব আদর, যত্ন, স্নেহে আমি ফার্স্ট হয়ে পাল্টম পেতে উঠলাম। এতদিনে গাড়ি চালানো মেট্রিক মফিজ গাড়ি চাচা আমার খোঁজ নিলেন। তাঁর বাড়িতে আমার আশ্রয় জুটলো।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছি আমি দিঘপাইত জুনিয়র হাইস্কুলে গঠন করি। চাচা ছেলে স্কুলের শিক্ষক। অন্য শিক্ষক আমার পাশের কথা জানতে। তাই সবার বাড়তি আদর-ভালোবাসা পেতাম।

আমি যখন সপ্তম সীমা পার করে অষ্টম বাড়াতে উঠবো, তখন চাচা অনুশীলন কোথেকে একটি নির্দেশনা নিয়ে এসেছিলাম। ডিজাইনার বিজ্ঞাপন ক্যাপ বারে বারে ফরম পুরণ করাটালাম। এখানে বলা দরকার, আমার নাম ছিল আতাউর রহমান। কিন্তু ক্যাডেট গ্রুপের গ্রুপ ফরমে স্কুলের হেডস্যার আমার নাম আতিউর রহমান ভয় চাকে বলেছেন, এই ছেলে বড়চা অনেক বড় কিছু হবে। দেশ অনেক আতাউর আছে। আমার নামটা পরীক্ষা প্রয়োজন; তাই আতিউর আদেশ করা।

আমি রাত জেগে করে নিলাম। প্রথম পাতা চাচার সঙ্গে পরীক্ষা দিতে রওনা হলাম। মেঘ আমার প্রথম ময়মনসিংহ নেওয়া। ছুই চড়গাছ ! এত ছেলের মধ্যে আমিই কেবল পায়জামা আর স্পঞ্জ পরে! আমার মনে করা, না আসাটাই ভালো ছিল। অহেতুক কষ্ট। একই পরীক্ষা; ভাবলাম হবে না। কিন্তু দুই মাস পর চিঠি পেলাম, আমি ঠিক হয়েছি। ঢাকা হতে হবে।

আল্লাহ খুব কেবল আমিই তাশ। আমার একটা প্যান্ট নেই, যেটা পরে যাবো। ড্যান স্কুলের কেরানী লাল বিশ্বাসের ফুলপন্টটা ধরনি। আর একটা শর্ট যোগ করা। আমি আর চাচা অচেনা উদ্দেশে রওনা হলাম। শেখ শেখ শিখে, মৌখিক পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি আমার কোণ এগিয়ে যেতে বলি: আমি কাম করতে চাই? ঠিক মতই। তবে এত উচ্চস্বরে যে, উপস্থিত ব্যক্তি হোসে উঠলো।

পরীক্ষকদের একজন মির্জাপুর ক্যাডেট ছাত্র অধ্যক্ষ এম. ডাব্লিউ পিট আমাকে আডমস্তক নিরীক্ষণ করে অনেক আঁচ করে ফেললেন। পরম স্নেহে তিনি আমাকে বসলেন। প্রথমের মধ্যে তিনি আমার খুব বড় হয়ে উঠলেন। আমার মনে করা, তিনি থাকলে আমার কোন ভয় নেই। পিট বিক্রেতা আমার প্রচারিত গরুর নজর বুলিয়া নিলেন। তারপর অন্য পরীক্ষকদের সাথে ইংরেজি কী- সবপ উপায়। আমি সবটা না বুঝ পাচ পারলাম যে, আমাকে পছন্দ হয়েছে। তবে সেখানে দেখতে না। পরদিন ঢাকা শহর স্থানীয় বাড়ি ফিরে এলাম। যথেষ্ট যোগ মনোনিবেশ কারণ আমি ধরেছি, আমার চান্স হবে না।

প্রথম তিন মাস পর চিঠি এলো। আমি পথ ধরি। মাসে ১৫০০ টাকা বেতন। এর মধ্যে ১০০ টাকা পরিবারকে দিতে হবে, বাকি ৫০ টাকা যোগদান করতে হবে। চিঠি পড়ে মন গেল। যেখানে আমার পরিবারের তিনবেলার নেই, আমি চাচার বাড়িতে মানুষ নিশ্চয়তা করতে পারি, সেখানে প্রতিমাসে ৫০ টাকা বেতন যোগ করার কথা চিন্তা করা যায় না!

এই যখন অবস্থা, তখন প্রথম গঠনের মতো আমার দাদা সরব। এত বছর পরনাতি (আমার) খোঁজ নিলাম। আমাকে অন্যদের চাচাদের কাছে যেতে বললেন, তোমরা আমাদের নাতি আমার এত ভালো সুযোগ পেতে না? কিন্তু আপনার অবস্থাও বেশি ভালো ছিল না। আবার বললেন, একবার না হয় ৫০ টাকা যোগাড় করে দেবো, কিন্তু প্রতি মাসে তো সম্ভব নয়। দাদাও বিষয়টা বুঝলেন।

আমি আর কোন আশা দেখতে না সেই ফালমুলাও আশার আলো পেতে। তিনি বললেন, আমি কোন চিন্তা করব না। পরদিন আরো দুইজন সহ আমাকে নিয়ে তিনি হাটেই অনেকদিন। সেখানে যেতে যেতে ঘুরছেন। বিস্তারিত বলুন মধ্য দিয়ে সাধ্য মত আট আনা, চার আনা, এক টাকা, দুই ভাগে। সব সুবিধা ১৫০ টাকা। আর চাচার বাকি ৫০ টাকা। আমি মির্জাপুর ক্যাডেট বিকল্প পাস হলাম। যাতায়াত খরচ বাদ দিয়ে আমি ১৫০ টাকা তিন টাকা বেতন পরিশোধ করতে। শুরুটা অন্য এক জীবন।

প্রথম পাতাই এম। ডাব্লিউ পিট আমাকে দেখতে আমি পছন্দ করি। আরো জানালাম যে, আমার আর বেতন সামর্থ্য নেই, তাই তিন মাস পরডেট ছেড়ে যেতে হবে। সকলের জন্য আমার বিষয়টা বোর্ড মিকে তুললেন এবং পুরো ১৫০ টাকা সুযোগের ব্যবস্থা করতে পারবেন। সেই থেকে আমাকে আর ফিরে আসতে হয়নি। এস.এস. পরীক্ষায় পরীক্ষাম স্থান অধিকার কর্তৃত্ব এবং আরো অনেক বিজয়ের মুকুট যোগ করা।

আমার জীবনটা সাধারণ মানুষের অনুদানে ভরপুর। পরবর্তীকালে আমি আমার এলাকায় স্কুল করেছি। যখন যাকে যতটা করতে পারি, সাধ্যমতো সাহায্যও করি। কিন্তু সেইহাট থেকে ১৫০ টাকা; সেই আমাকে আজও শোধ করা হয়নি। আমার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করতেও সেই যোগাড় হবে না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *